নিঃশব্দ হত্যাকারী - সাত সকালে দশদিক
০১
ইতিহাস-রাজনীতি
০২
খেলাধূলা-শরীরচর্চা
০৩
বিনোদন-সংস্কৃতি
০৪
অপরাধ-দুর্নীতি
০৫
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি
০৬
ব্যবসা-অর্থনীতি
০৭
শিক্ষা-কর্মজীবন
০৮
সমাজ-পরিবেশ
০৯
জীবনশৈলী-গৃহস্থালী
১০
ধর্ম-রীতিনীতি
পড়ুন দশদিক, নজরে রাখুন দশদিক

নিঃশব্দ হত্যাকারী

সোমনাথ আদক


সন্ত্রাসবাদী হামলা বললে চোখের সামনে যে ছবিগুলো ভেসে ওঠে, সেগুলো হলো হেমন্তের ঝরা পাতার মতো ছড়িয়ে থাকা লাশ, বয়ে যাওয়া রক্তের স্রোতে ভিজে যাওয়া মাটি। হাজারো মানুষের হাহাকার, চোখের জল। আর আট থেকে আশি মৃত্যুর সামনা করা ভয়ার্ত মুখ। অনেকরকম সন্ত্রাসবাদী হামলা দেখেছে বিশ্ববাসী। স্কুলে ঢুকে কচি-কাঁচাদের নির্বিচারে গুলি করে খুন, আত্মঘাতী হামলা, বোম ব্লাস্ট, মুম্বাইয়ে তাজ হোটেলে হামলা। আমারেকায় লাদেনের টাওয়ার ওড়ানোর মতো টেরোরিস্ট অ্যাটাকের মতো ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আছে। এখানে আক্রান্তকারী ও আক্রান্ত দু-পক্ষকেই দেখা যায়। তবে এখন যে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের কথা বলতে যাচ্ছি সেখানে আক্রান্তকে দেখা যায়। কিন্তু আক্রমণকারী ইনভিসেবেল। অর্থাৎ খালি চোখে তাকে দেখা যায় না। তার নাম জৈব সন্ত্রাস। জৈবিক অস্ত্র ব্যবহারের ধারণা নতুন নয়। বরং ইতিহাসের বলে, জৈবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রচেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই চলেছে। জৈবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রথম নথিভুক্ত উদাহারণ পাওয়া যায় ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

১৭১০ সালে রাশিয়ানরা এস্তোনিয়ার রিভাল শহরে সুইডিশ বাহিনীকে ঘেরাও করে। তখন রাশিয়ানরা প্লেগের কারণে মারা যাওয়া মানুষের মৃতদেহ সুইডিশ শিবিরে নিক্ষেপ করেছিল। খ্রিস্টীয় আঠারো শতকে ফরাসি এবং ভারতীয় যুদ্ধের সময়, স্যার জেফ্রি আমহার্স্টের নির্দেশে ব্রিটিশ বাহিনী রোগ ছড়ানোর উদ্দেশ্যে গুটিবসন্তে আক্রান্তদের ব্যবহৃত কম্বল আমেরিকানদের ব্যবহার করার জন্য দিয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, জার্মান সেনাবাহিনী প্রধানত জৈবিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অ্যানথ্রাক্স, গ্ল্যান্ডারস, কলেরা এবং গম আক্রমণকারী ছত্রাক তৈরি করেছিল। জার্মানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে প্লেগ ছড়িয়েছিল। মেসোপটেমিয়ায় খচ্চরদের গ্ল্যান্ডারস দ্বারা সংক্রমিত করেছিল এবং ফরাসি অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়াগুলোর সাথেও এ ধরনের কাজ করার চেষ্টা করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা না হওয়া এবং পাশাপাশি মিথ্যা ও উদ্বেগজনক গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরে, বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশসমূহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হওয়ার অনেক আগে থেকেই তাদের নিজস্ব জৈবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করেছিল।

জাপানি জৈবিক অস্ত্র কর্মসূচির জনক শিরো ইশি ভেবেছিলেন, জৈবিক অস্ত্র জাপানের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানি বাহিনী মাঞ্চুরিয়ায় একটি গোপন বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার রিসার্চ ফ্যাসিলিটি পরিচালনা করেছিল, যেখানে বন্দীদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো।

তারা রোগের বিকাশ ও সংক্রমণের মাত্রা পরিমাপ করার উদ্দেশ্যে তিন হাজারেরও বেশি বন্দীকে প্লেগ, অ্যানথ্রাক্স, সিফিলিস এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত করেছিল। মানবদেহে এসব ক্ষতিকারক জীবাণুর প্রভাব সম্পর্কে আরও বেশি জানার জন্য সংক্রমণে মারা যাওয়া বন্দীদের ময়নাতদন্তও করা হয়েছিল। যুদ্ধের সময়, জাপানি সেনাবাহিনী কলেরা এবং টাইফয়েডের প্রকোপ সর্ম্পকে জানতে চীনের বিভিন্ন গ্রামে এক হাজারেরও বেশি জলের কুয়োয় কলেরা এবং টাইফয়েডের জীবাণু ছড়িয়েছিল। উত্তর আমেরিকাতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে জৈব অস্ত্র গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল। নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী স্যার ফ্রেডরিক ব্যান্টিং কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তায় ১৯৪০ সালে প্রথম বেসরকারি জৈবিক অস্ত্র গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এরপরেই জার্মানদের জৈব হামলার ভয়ে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা মার্কিন সরকারের উপর জৈবাস্ত্র সর্ম্পকিত গবেষণা করার জন্য চাপ তৈরি করেছিল। যদিও নাৎসিরা কখনও জৈবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। জাপানিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জৈবিক অস্ত্র তৈরির জন্য একটি বড় আকারের প্রকল্প শুরু করেছিল এবং অবশেষে চীন দখলের উদ্দেশ্যে সেগুলো ব্যবহার করে। ১৯৪২ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জৈবিক যুদ্ধ গবেষণা পরিষেবা গঠন করে এবং প্রাথমিকভাবে অ্যানথ্রাক্স এবং বটুলিনাম টক্সিনকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায় কি না, সে বিষয়ে গবেষণা করেছিল। জার্মান বাহিনী যদি প্রথমে জৈবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তবে তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবার জন্য ১৯৪৪ সালের জুনের মধ্যে তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে বটুলিনাম টক্সিন এবং অ্যানথ্রাক্স মজুদ করে নিয়েছিল। ব্রিটিশরা ১৯৪২ এবং ১৯৪৩ সালে স্কটল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে গ্রুইনার্ড দ্বীপে অ্যানথ্রাক্স বোমা পরীক্ষা করে।

সোভিয়েত ইউনিয়িন বায়োপ্রিপিয়ার্ট নামে একটি বিশাল জৈবিক যুদ্ধবিগ্রহ প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত করে, যার পরিধি এত বিশাল ছিলো যে তারা ৫০,০০০-এরও বেশি লোককে বিভিন্ন গবেষণা ও উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে নিয়োগ করেছিল। এ প্রকল্পে তারা বিশাল পরিমাণে এনথ্রাক্স, ব্যাসিলি এবং গুটিবসন্ত ভাইরাস উৎপাদন এবং মজুদ করেছিল। তারা মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক জীবাণু হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাসের উপর গবেষণাও করেছিল।

যুদ্ধের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিছু জাপানি জৈবিক অস্ত্র গবেষককে যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে, কিন্তু আমেরিকা সে সমস্ত গবেষককে মুক্তি দিয়েছিল। এমনকি ইশি'র উত্তরসূরী মাসাজিকিতানো যুদ্ধের পরে চীনে যুদ্ধের সময়ে মানুষের উপর করা পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর গবেষণাপত্র প্রকাশ করে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়, ভিয়েতনামের কঙ্গো গেরিলারা সূঁচালো পাঞ্জালাঠি মলে ডুবিয়ে শত্রুকে ছুরিকাঘাত করার জন্য ব্যবহার করেছিল। যাতে তারা পরবর্তী সময়ে মারাত্মক সংক্রমণের শিকার হয়। ১৯৭১ সালে আরালস্কের কাজাখ শহরে গুটি বসন্তের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল এবং আক্রান্ত দশজন লোকের মধ্যে তিনজন মারা যায়। মনে করা হয়, তারা এরাল সাগরের একটি ছোট দ্বীপে অবস্থিত জৈবিক অস্ত্র গবেষণা কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল। একই অঞ্চলে, কিছু জেলে প্লেগ এবং এক গবেষক গ্ল্যান্ডারসের সংক্রমণে মারা গিয়েছিলেন।

১৯৭৯ সালে, সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশ কালোবাজারে বিক্রি হওয়া অ্যানথ্রাক্স-দূষিত প্রাণীদের মাংস থেকে সোভেরড্লোভস্কে হওয়া অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাবকে আড়াল করার চেষ্টা করে ছিলেন। কিন্তু পারেননি। শেষ পর্যন্ত প্রমানিত হয়, প্রাদুর্ভাবটি জৈবিক অস্ত্র তৈরির কারখানায় দুর্ঘটনার কারণে ঘটেছিল, যেখানে একটি আটকে থাকা এয়ার ফিল্টার সরানোর পর আর প্রতিস্থাপন করা হয়নি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা এবং জৈবিক অস্ত্র শীঘ্রই 'দরিদ্রের পারমাণবিক বোমা'য় পরিণত হতে পারে, এ উপলব্ধির কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিক্সন আক্রমণাত্মক জৈবিক অস্ত্র গবেষণা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৭২ সালে বায়োলজিক্যাল অ্যান্ড টক্সিন ওয়েপন কনভেনশনে স্বাক্ষর করেন, যেটি ১৯২৫ সালের জেনেভা প্রোটোকলের সংশোধিত রূপ।
১৯৮৫ সালে ইরাক অ্যানথ্রাক্স, বটুলিনাম টক্সিন এবং আফলাটক্সিন তৈরি করার উদ্দেশ্যে একটি আক্রমণাত্মক জৈবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করে। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের সময় মিত্রবাহিনীর জোট রাসায়নিক এবং জৈবিক অস্ত্রের হুমকির মুখোমুখি হয়েছিল। পার্সিয়ান উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে ইরাক স্বীকার করেছিল যে, তাদের কাছে বটুলিনাম টক্সিন, অ্যানথ্রাক্স এবং আফলাটক্সিন দ্বারা সজ্জিত বোমা, স্কুড ক্ষেপণাস্ত্র, ১২২ মি.মি. রকেট এবং আর্টিলারি শেল ছিল। এছাড়াও তাদের কাছে বিমানের সাথে লাগানো স্প্রে ট্যাঙ্ক ছিল, যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে জৈব এজেন্ট নিক্ষেপ করতে পারে। ১৯৯৪ সালে, জাপানের আউম শিনরিকিও সম্প্রদায়ের একটি উগ্র গোষ্ঠী টোকিও শহরের ভবনের ছাদ থেকে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু বাতাসে ছড়ানোর চেষ্টা করেছিল।

১৯৯৫ সালে, তারা টোকিও শহরের পাতাল রেলে স্যারিন গ্যাস ব্যবহার করে, এতে ট্রেনের ১২ জন যাত্রী নিহত এবং ৫ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছিল। সে বছরেই, মিনেসোটা মিলিশিয়া গ্রুপের দুজন সদস্যকে রাইসিন রাখার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যেটি তারা স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিজেরা তৈরি করেছিল। পরের বছর, ওহিও শহরের এক ব্যক্তি ডাকযোগে বুবোনিক প্লেগ ছড়াবার চেষ্টা করেছিলেন। ২০০১ সালে, অ্যানথ্রাক্সের জীবণু ডাকযোগে মার্কিন মিডিয়া এবং সরকারি অফিসগুলিতে পাঠানো হয়েছিল, ফলে সেখানে পাঁচজন মারা গিয়েছিল। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে একটি অ্যাপার্টমেন্ট 'রাইসিন পরীক্ষাগার' হিসেবে ব্যবহৃত করার অপরাধে ছয় সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়; তাদের মধ্যে ২৭ বছর বয়সী একজন রসায়নবিদ ছিলেন, যিনি এই রাইসিন তৈরি করছিলেন।
পরবর্তী সময়ে, ৫ জানুয়ারি, ২০০৩ সালে ব্রিটিশ পুলিশ লন্ডনের আশেপাশে দুটি বাসভবনে অভিযান চালিয়ে রাইসিনের সন্ধান পেয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, চেচিন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রাশিয়ার দূতাবাসে রাইসিন আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। ২০০৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, তিনটি মার্কিন সিনেট অফিস ভবন বন্ধ করা হয়েছিল; কারণ, ভবনগুলোর চিঠিপত্র রাখার কক্ষে রাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল।

পারমাণবিক বোমা যতটা সশব্দে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, জৈবাস্ত্র ঠিক ততটাই নীরবে ঘাতকের কাজ করে যাচ্ছে। তাই এ কথা অনুমান করা কঠিন নয়, ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে হয়তো পারমাণবিক বোমার জায়গা দখল করবে জৈবিক অস্ত্র।